তন্ত্র বলতেই মানুষের ধারণা পঞ্চ ম কার অর্থাৎ মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন । কিন্তু তন্ত্র তা নয়। তনুকে ত্রাণ করে যা তাই তন্ত্র এবং মনকে ত্রাণ করে যা তাই মন্ত্র। নির্গুণ, নিরাকার পরব্রহ্মের মধ্যে সৃষ্টি বাসনা জাগ্রত হলে তিনি সগুণময়রূপ প্রকাশিত হন। এই গুণত্রয় তাঁর মধ্যেই সুপ্ত ছিল । সত্ত্ব, রজ, তম। সৃষ্টিকালে তাঁর মধ্যে এই ত্রিগুণই জাগ্রত হয়েছিল। এই সগুণময় ব্রহ্মই সৃষ্টি, স্থিতি, বিনাশ সক্ষম। তাই এঁকে নারীরূপে কল্পনা করা হয়েছে কারণ নারী জীবের জন্ম, পালন এবং বিনাশ সক্ষম। ইনিই শক্তি। ব্রহ্ম এবং শক্তি তাই অভেদ। অনেক সাধক এই সগুণ ব্রহ্ম এবং ক্রিয়াময়ী শক্তির মধ্যে আবার পৃথক সূক্ষ্ম পার্থক্য করেছেন ।এই শক্তি আবার বিদ্যা এবং অবিদ্যা শক্তিরূপে কর্ম করেন। বিদ্যা শক্তি জীবকে অজ্ঞান থেকে জ্ঞান সহায়ে মুক্ত করেন এবং অবিদ্যা শক্তি জীবকে অজ্ঞান দ্বারা বদ্ধ করেন। এই হল মায়া। বৈষ্ণবগণ মায়াকে তিনপ্রকার বলেছেন – পরা, অপরা, পরাপরা।এই মায়া দ্বারাই শক্তি জগত সৃষ্টি করেন। জগত সৃষ্টির প্রধান উপাদান পঞ্চ তত্ত্ব – রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ ।এই পঞ্চ তত্ব থেকে পঞ্চভূত বা পঞ্চ তন্মাত্র – প্রথমে ব্যোম বা মহাশূন্যের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ধারণী মাধ্যম যা ইথার নামে পরিচিত । দ্বিতীয় তেজ এরপর মরুৎ বা বায়ু, অপ বা জল এবং ক্ষিতি বা মাটি। এর থেকে আবার পঞ্চ জ্ঞাণেন্দ্রিয় – চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। এরপর এই পঞ্চ জ্ঞাণেন্দ্রিয়র ইচ্ছা অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের জন্য পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় যা মিলিত হয়ে জীবদেহ তৈরী হচ্ছে।এই পঞ্চতত্ত্ব, পঞ্চতন্মাত্র এবং পঞ্চ জ্ঞাণেন্দ্রিয়র সমাহারে তৈরী হয় মন যা সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশশীল। তাই শক্তি হলেন মনোময়ী।তাই তন্ত্র সাধনায় পাঁচ সংখ্যার এত ব্যবহার । পঞ্চ মুন্ডাসন, পঞ্চ ম কার, পঞ্চপল্লব।পঞ্চ ম কার দুই ভাবে সাধনা করা হয়। সাধারণত সাধক গণ যারা প্রবৃত্তি মার্গ হতে নিবৃত্তি মার্গে যাওয়ার সাধনা করেন তারা আক্ষরিক অর্থে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুনের সাধনা করেন। এইভাবে সাধনা অতি দুরূহ ।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পতন হয়ে থাকে । যেহেতু সাধারণ মানুষ পশুর ন্যায় তাই সাধারণ মানুষের জন্য পঞ্চ ম কার সাধনা বিহিত নয়। তারা জপ, ধ্যান, ভক্তি মার্গেই সাধনা করবেন।কিন্তু বীর সাধকগণ সূক্ষ্ম ভাবে এই সাধন করে থাকেন ।আগমসারে তাই বলা হচ্ছে -মদ্য– সাধকের ব্রহ্মরন্ধ হইতে ক্ষরিত সোম ধারাকে ‘মদ্য’ বলে। মাংস– মা অর্থে রসনা। রসনার অংশ বাক্য ও বাসনা অর্থাৎ বাক্য সংযম করে সেই যোগী পুরুষকেই মাংস সাধক বলা যায়।মৎস্য– ইড়া, পিঙ্গলা মধ্যে যে শ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহ তাহাই মৎস্য অর্থাৎ প্রণায়াম দ্বারা প্রানকে স্হির করেন তিনি মৎস্য সাধক।মুদ্রা– স্বশরীরস্হ মস্তকে সহস্রদল কর্ণিকা মধ্যস্হিত পারদের ন্যায় নির্মল শুভ্রবর্ণ কোটি সূর্য্যচন্দ্র আভা অপেক্ষা অধিক প্রকাশ অথচ শীতল আভাযুক্ত কমনীয় এবং মহাকুণ্ডলিনী সংযুক্ত যে আত্মা আছেন তাহাকে যিনি জেনেছেন তিনিই মুদ্রা সাধক।মৈথুন– সাধনায় বদ্ধ জীবাত্মাকে মুক্ত করিয়া পরমাত্মার সহিত মিলনকে মৈথুন বলে।এই মৈথুন সাধনায় বীরাচারী সাধক নিজেকে শিব এবং নারীকে শক্তি ভেবে রমণের মাধ্যমে শক্তিকে সন্তুষ্ট করে থাকেন । এই সাধনায় ভৈরবী প্রয়োজনে। ভৈরবী হলেন ভৈরব বা সাধকের শক্তি। তাই নিজ স্ত্রী থাকলে তিনিই এই ভৈরবী হয়ে সাধক র সাধন সহায়িনী হন। অন্য নারীকে ভৈরবী করতে গেলেও তাঁকে শৈবমতে বিবাহ করার নির্দেশ রয়েছে । কারণ শ্যামা রহস্যমের সেই শ্লোকটিতেই বলা হচ্ছে একই কালিকা দেবী সন্তান জন্ম কালে জননী রূপে, স্নেহকালে কন্যারূপে, ভোগ বা সম্ভোগকালে ভার্য্যা বা পত্নীরূপে এবং অন্তকালে ইষ্টদেবী কালীর রূপে ত্রিভূবনে বিরাজ করছেন। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন।আদ্যতত্ত্বং বিদ্ধিতেজো দ্বিতীয়ং পবনং প্রিয়ে।।অপস্তৃতীয়ং জানীহি চতুর্থং পৃথিবীং শিবে।পঞ্চমং জগদাধারং বিয়দ্বি দ্ধি বরাননে।। ( মহানির্বাণ তন্ত্র )।প্রিয়ে তেজই আদ্যতত্ত্ব মদ্য ; পবন দ্বিতীয় তত্ত্ব মাংস ; জল তৃতীয় তত্ত্ব মৎস্য ; পৃথিবী চতুর্থ তত্ত্ব পবন আর এই জগদাধার অন্তরীক্ষই পঞ্চম তত্ত্ব মৈথুন।তাই পঞ্চতত্ত্ব স্বরূপ পঞ্চদেবতার আসনে নির্গুণ পরব্রহ্ম স্বরূপ উলঙ্গ শবশিব শুয়ে। শবশিবের শিশ্ন কিন্তু উত্থিত কারণ তাঁর মধ্যে সৃষ্টি বাসনা জাগ্রত । তাঁর নাভিকমল অর্থাৎ কেন্দ্র হতে প্রকাশিত সগুণ শিব যাঁর কোলে উপবিষ্টা উলঙ্গিনী কালী পরাশক্তি কারণ শক্তি বিশ্বব্যাপিনী। তিনিই সৃষ্টি, স্থিতি, বিনাশ কারিণী। তিনিই জীবের কর্ম সঞ্চিত রেখে কর্মের ফল দান করেন। এই জগত সংসার তাঁরই ছায়ামাত্র। নিত্য নিরন্তর তিনি শিবের সঙ্গে রমণ করে চলেছেন এই সৃষ্টি কার্য্য পরিচালনার জন্য। একই সঙ্গে তিনি পালন করছেন এই সৃষ্টিকে আবার বিনাশও করছেন। আধুনিক বিজ্ঞান একে জড় শক্তি বলছে কিন্তু তন্ত্রে ইনিই চৈতন্য রূপিণী।
